শিরোনাম নাই

 ইদানিং বিশ্বব্যপী লকডাউনের সময় বেশ দুপুর দুপুর ঘরে ফেরা হয় । জীবিকার কারনেই এই তীব্র মহামারীর সময় ঘর থেকে বের হতে হয় । প্রায় বিরান রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশী জেরার বিরক্তি ছাড়া আর যা কিছু বাকী থাকে তা হলো সংক্রমণের ঝুঁকি, সিনেমার মতোন কিছু ফ্রেম আর ছেঁড়া মানুষের সুখ দুঃখ।
ল্যাখালিখিতে শেষোক্ত বিষয়টার অনুপস্হিতির কারণে প্রগতিশীল বন্ধু মহলে আমার বিশেষ দুর্নাম আছে –  বিশেষত যাঁরা খুব কাছে থেকে পৈতৃক সুত্রে আমার  ‘কাপিতালিস্ত’ ‘বুর্জোয়া’ ও 'প্রোলিতারিয়েত’ উত্থান ও পতন দেখেছেন।  এমনকি প্রেয়সী, যিনি আমার ‍ঔরসজাত সন্তানের মা, সকালের ভিডিও বার্তায় চলমান মহামারীতে আমার নির্বিকারত্ব নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন।
এ চিঠি কিছুটা সেই সব সওয়ালের জবাব, কিছুটা দৈনিক দিননামার অংশ, কিছুটা অতীত এবং বর্তমানের মাঝে একটা দাগ টেনে কাটাকুটি খ্যালা।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
করলা আমার প্রিয় খাদ্য হলেও চার চাকার স্বাচ্ছন্দ্য আমার কখনোই নাই। তাই যেদিন কপালে জোটে, ঘর থেকে কিলোটাক দুরেই ড্রাইভার সাহেবকে বিদায় দিয়ে বাসার পথ ধরি । ইদানিং রাস্তাঘাট ট্র্যাফিক মুক্ত থাকায় কানে থাকে ব্রায়ান ইনো ।
এই চৈত্রের দুপুর কিছুক্ষণ আগেও লেপ্টে ছিলো – কাঁচ ও রৌদ্রে,  এলকোহল ও জীবাণুনাশকের তীব্র ঘ্রাণ নিয়ে। এ য্যানো সদ্য হাশর ভাঙা পরিত্যক্ত নগরী, মানুষ তার প্রাপ্য নিয়ে ফিরে গ্যাছে ইললিনে, সিজজিনে। কেবল ইতস্তত কিছু অমিমাংসিত আত্মারা পাঠ করে 'ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি' – খুঁজে ফেরে জীবিকা, খাদ্য, জীবানুনাশক এবং পয়সা ছেটানো গাড়ি ।
সেদিন আমেরিকায় ছয় সপ্তাহের শিশু নাকি মারা গ্যাছে করোনায় –  বাংলাদেশে সে কেবল আলাপ সারতেছে , মূল রাগ যে সে আর কিছুদিন পরে বাজাবে তা বিশেষজ্ঞজনাদের ইংগিতেই স্পস্ট। আমার বাচ্চাটারে কোলে নিতে ইচ্ছা করে। নরোম হাঁসের ছানার মতো রোমশ বাচ্চাটারে বুকে নিয়া বেথোভেন শোনাতে মন চায়, দিনে দুপু্রে স্যঁপার নকচার্ন শুনায়ে তারে ঘুম পাড়াইতে মন চায়। তারে বলতে মন চায় সন্তানের জন্য কী যে অগনিত মহামূল্য দুপুর ও ভাতঘুম পিতারা হাসিমুখে উৎসর্গ করে। ঈশ্বরের উপর এক কাব্যিক ক্রোধ জমা হয়। কানে কানে মহাজাগতিক বিষ ঢালতে থাকে ব্রায়ান ইনো।
আকাশে তাকাই। কী পরিচ্ছন্ন নীল !! আমাদের নগরীর বিপন্ন, বিক্ষিপ্ত ইতস্ততঃ সবুজ আরো সবুজ হয়ে কিলিবিলি করে তার বুক ছুঁতে চায় – ঠিক আমাদের বাচ্চাটার মতোন। খবোরে বলে মানুষের অনুপস্হিতিতে নাকি প্রকৃতি কি কি নৈসর্গিক মেরামতির কেরামতি করতেছে দুনিয়া জুড়ে। আকাশের দিকে তাকাই – কানের দুপাশে চৈত্রের সেই হারানো হুতাশ হাওয়া…শৈশবের মফস্বলে ফিরে যাই – যেখানে একটি কর্কট মৃত্যুজনিত নষ্ট কিশোরের একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত ল্যুদমিলা পিয়েতা।
অজান্তেই দুপুরগ্রস্হ  আমি নতজানু হই খোলা রাস্তায়। ঈশ্বরের প্রতি অঘাত প্রেম এবং কৃতজ্ঞতা জমা হয় । কানে কানে আন্তঃনাক্ষত্রিক প্রার্থনা সংগীত বাজাতে থাকে ব্রায়ান ইনো ও তাঁর দল। 

‘আমি নাস্তিক নই তাই সপ্তাহে একবার
নতজানু হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি বারেবার
বৈরাগ্য রোগাতুর এ উড়নচন্ডি হৃদয়
তোমাকে পাঁজর বানিয়ে খুঁজে পাক আশ্রয়’
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে আমার বিজ্ঞ বন্ধুগণ প্রায়শঃই বলে থাকেন যে সে সকলের উপর কর্তৃত্ব করতে পারে এবং তার সর্বোৎকৃষ্ট উদ্ভাবনী ক্ষমতা আছে। কেউ কেউ অবশ্য একথাও বলে থাকেন যে জীব জগৎ এ মানুষের বাঁচার অধিকার আগে, তারপর অন্য সবার -  অত্যন্ত মানবিক ব্যপার সন্দেহ নাই।
অর্থাৎ যে সে সকলের উপর কর্তৃত্ব করতে পারে এবং যার সর্বোৎকৃষ্ট উদ্ভাবনী ক্ষমতা আছে জীব জগৎ এ বাঁচার অধিকারে তাকেই আমরা অগ্রগণ্য ধরে নেবো।
তাহলে কী যে মানুষ বা গোষ্ঠী সকলের উপর কর্তৃত্ব করতে পারে এবং যার/যাদের সর্বোৎকৃষ্ট (কুটিল জটিল মারনী ও উচাটনী) উদ্ভাবনী ক্ষমতা আছে মানব সমাজে বাঁচার অধিকারে তাকেই আমরা অগ্রগণ্য ধরে নেবো ? তা দুনিয়া তো এই নিয়মেই চলতেছে, মোড়ক ও মার্কেটিং খালি ভিন্ন।
আচ্ছা তর্কের খাতিরে যদি মাইনাই নিই যে ঘটনা এরূপ তাহলে মনে করি আরেক বিশ্ব থেকে আমাদের চাইতে বুদ্ধিমত্তা ও কর্তৃত্বে বিশাআআআআল বড়ো কোন প্রাণীর দল দুনিয়াতে পা রাখলেন। তা তারাও আমাগো ভাষা বোঝেনা আমরাও তাগোটা না। এখন দুধ ও মাংসের জন্য তারা যদি মানুষের আবাদ শুরু করে দ্যায়, আমরা গরু ছাগল দিয়া য্যামোন করি, বিষয়টা কি মানা যায় ?
আমি জানি এই দুর্বল বিতর্ককে বহু যুক্তি দিয়েই বাতিল করা যায় অতি সহজেই, এবং আমার বিজ্ঞ বন্ধুগণের নিকট এইটা এক তুড়ির বিষয় কিন্ত একবার এই কোয়ারেন্টাইনে বইসা ভাবা উচিৎ, করোনা আমাদের কি শিখায় যাচ্ছে।
একবার ভাবি তো কোভিড-১৯ তার বাহকের ফুসফুসের সাথে যা করছে আমি আমার বাহকের ফুসফুসের সাথে গ্যালো বছর কী কী করছি ? এইখানেও নানা রকম শক্ত পোক্ত রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক বিতর্ক আছে, তাতে বিপক্ষের বিতার্কিক জিতবেন অবশ্যই – তবে মূল যে জায়গাটা, দর্শনের যে যায়গাটা, তা অপরিস্কার ও দুর্বল থাকলে কোন তন্ত্র মন্ত্র বা যন্ত্র দিয়ে কথিত সভ্যতা টিকায় রাখা সম্ভব না তা হালের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়েও না। কারণ সংশয় শুধু সংশয়কেই আরো সুচারুভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলে।

মানুষ বিশ্বাসী প্রাণী। সে কিছু না কিছুতে অবশ্যই বিশ্বাস রাখে –  মনে, মগজে ও প্রাণে। কেউ ধর্মে, কেউ অধর্মে, কেউ বিজ্ঞানে, কেউ রাজনীতিতে, কেউ দর্শনে, কেউ বিশ্বাস রাখে 'কোন কিছুতেই না' ……………………. এই বিশ্বাস তার বেঁচে থাকার উৎসাহ, তার জীবনের অর্থ , একটি মানদন্ড বা স্ট্যান্ডার্ড।
 জাতি ধর্ম বর্ণ গন্ধ নির্বিশেষে ২০২০ খ্রিস্টাব্দে আমরা একটি রূপকথায় বিশ্বাস রাখি – অর্থনীতি। খ্রিস্টপূর্ব গ্রিক কবি হেসিওদ কিংবা ১৭ শতকের আদম স্মিথ কার হাত ধরে এর রচনা এ বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও পৃথিবীর ইতিহাসের তুলনায় অর্থনীতি – তার সামগ্রিক অর্থে –   এখনো শৈশবেই আছে।
এইখানে এসে একটা বিষয়ে বলবার লোভ সামলাতে পারছি না – দর্শনের ইতিহাসের দুই প্রবাদ পুরুষ সক্রেতস ও প্লাতো ছিলেন কবিদের উপর উচ্চমার্গীয় খ্যাপা। কারণটা বুঝতে একটা রেফারেন্স টানি –  গবেষকদের মতে তাঁদের সময়ে 'ধর্মগ্রন্হ' বলতে ঐ কবিদের তথা হোমরের কাব্য শোলকই ছিলো সুলভ ও অকাট্য। ফলে 'জীবনের সর্বত্র কাব্যের এই ধর্মীয় প্রভাবকে প্লেটো যুক্তির প্রতিশক্তি মনে করতেন।' [প্লেটোর রিপাবলিক অনুবাদ সরদার ফজলুল করিম, দশম পুস্তক, পাতা ৪৬৮]
ত্যামোনই একজন কবি হেসিওদ সাহেব, অন্য জনাদের মাঝেও, এই অর্থনীতি নামক 'ধর্মবিশ্বাসে' কিছুটা হলেও কিছু সময়ের জন্য প্রভাব রেখে গ্যাছেন।    
সুতরাং, এমন অনুমান করাটাও বোধোয় খুব বেশী কাব্যিক হবেনা যে,  'প্রাচীন ধর্মসমুহের মতন’,  'প্রাচীন অন্ধ বিশ্বাসের মতন' অথবা প্রাচীন কবির ঘোরগ্রস্হ প্রলাপ বলে সে গল্প খারিজ হয়ে যেতেও পারে কোন সুদূর ভবিষ্যতে। অর্থনৈতিক শক্তি ও স্বচ্ছলতা অর্জনের স্বর্ণালী সংগ্রাম হয়তোবা ইতিহাসের কোন কালো অধ্যায়ে নতুন করে ল্যাখা হবে নরমাংস ভক্ষণ বা সতিদাহ প্রথা ইত্যাদির সমপর্যায়ের…………… কোন সুদূর ভবিষ্যতে।
সক্রেতস সাহেব অবশ্য কবিদের সমালোচনা করতে গিয়ে ফ্যান ফলোয়ারের এক রেফারেন্স টানছেন বটে – আধুনিক সমাজ ব্যবস্হায় আস্তিক, নাস্তিক, ডান, বাম, লাল ও সবুজ বিপ্লবী, মেক আম্রিকা হোয়াইট এগেন, ফ্যাসিস্ট ফেটিশ ইত্যাদি সকলেরই যথেস্ট ফ্যান-ফলোয়ার, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বিত্ত থাকার পরেও কাজের কাজ ঠিক হয়ে উঠতেছে না। আমি এইখানে অবশ্যই কবিদের সাফাই গাইতে বা দুই দার্শনিক শিরোমনির যুক্তির অসারতা নিয়ে বিতর্ক করছি না – ব্যাওয়ারিশ চিঠি মানে তো কিছু স্বতস্ফূর্ত বাতুলতা!!!
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
'বাস্তবতা’ খুব বেশী 'বাস্তব' বা 'কঠিন' হয়ে গ্যালে – মানে তা খুব বেশী 'রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক' ও উনসুনি বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করলে যে 'পরাবাস্তবতা' ও 'পর-লোক' চর্চার একটা স্বতঃস্ফূর্ত উত্থান ঘটে – তা জানতে বুঝতে দার্শনিক বা বিজ্ঞানী হতে হয় না।
কিন্ত, এন্টারকোটিক রাজ্যের বেতাজ বাদশাহ ডক্টর ডাক্তার ইব্রামোভিচ বা বৈজ্ঞানিক ও বিশিষ্ট ইসলামিক চিন্তাবিদ রাস্ট্রনায়ক আবু ইভাঙকা কে চেনা ও আক্রমন করা যতটা সহজ – রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও বৈজ্ঞানিক পয়ঃপ্রক্রিয়া, তথ্য, উপাত্ত ইত্যাদি নিয়া যাঁরা হাতে কলমে কাজ ও লিখালিখিতে আত্মোৎসর্গ করেন তাঁদের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম উদ্দেশ্য-বিধেয় জানা-বোঝা তার চাইতে সহস্র গুন কঠিন। কোভিড ১৯ চরিত্রের সাথে তাঁদের মিল নিছকই অনভিপ্রেত কাকতাল হতেই পারে।
অবশ্য এসব বিষয়াদি নির্মোহ ভাবে বোঝার জন্য বিবিধ শাস্ত্র ও সাধন হন্তদন্ত তদন্ত সহযোগে মস্তিস্কের ব্যপক অনুশীলনের কোন বিকল্প নাই – সে এক চলমান ও জীবনব্যপী প্রক্রিয়া; নিঃসন্দেহে ।

পুনশ্চঃ এই পত্রের কোন প্রাপক বর্তমানে নাই। দূরবর্তী কোন সময়ের কারো জন্যে রেখে গ্যালাম । সময় সুযোগ মতন সে পড়ে নেবে আশা করি।

Comments

  1. অসাধারন দাদা, আসলে কি , খুব বদ্ধ অনুভব করতেসি। একেবারে আলাদা অনুভুতি। ভালে না খারাপ তাও বুঝতেসি না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ রে, পরাবাস্তব লাগতাছে সব কিছুই ।

      Delete

Post a Comment